হজ্জ কিংবা ওমরার সফর প্রতিটি মুসলমানের বহুল আকাঙ্ক্ষিত একটি সফর । দিলের মধ্যে এই আকাঙ্ক্ষা পুষতে পুষতে তা পূরণ হওয়ার আগেই অনেকের আখিরাতের সফর মৃত্যু চলে আসে । আর ভাগ্যবান কিছু মানুষ তাদের জীবদ্দশায় এ সফরের ডাক পেয়ে যায় । মুবারক এই সফরের মুসাফির হতে শুধু জাগতিক ভিসাই যথেষ্ট নয়, আসমান থেকে এ সফরের ভিসা পাস করাতে পারলেই কেবল বরকতময় এ হাজিরির সুযোগ মিলে ।
আসমানি ভিসা কেন্দ্রের সে অফিস ধনী, গরিব সাদা-কালো সবার জন্য দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা । যার কোন অফডে নেই । সেখানে যখন তখন আবেদন করা যায় । বারবার আবেদন করতে থাকতে হয় । করুনাময় রবের রহমতের দরিয়ার উত্তাল সমুদ্রে যখন ঢেউ ওঠে, সেই মুহুর্তে করুনার হাত পাততে পারলে আপাদামস্তক গুনাহে জর্জরিত অনেক পাপী-তাপীও খোশ নসীব হয়ে যায়— মুবারক কাফেলায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পেয়ে যায় । চলুন আজ থেকেই আবেদন শুরু করি ।
যাহোক, আজকের আলোচনার মূল বিষয় হচ্ছে হজ্জ ওমরার প্রস্তুতি কীভাবে নিবেন । সে বিষয়ে অতি সংক্ষেপে কিছু দিকনির্দেশনা । প্র্স্তুতির অন্য সকল আলোচনায় আসলেও যে দিকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ— আজকের আলোচনা কেবল সে পয়েন্টটি নিয়েই ।
হজ্জ-ওমরা একটি আর্থিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক সফর । মুবারক এ সফর শুরু করার আগে আমরা আর্থিক, দৈহিক ও অফিসিয়াল প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও আত্মিক প্রস্তুতির কথা আমরা অধিকাংশই ভুলে যাই । অথচ এটাই হচ্ছে প্রস্তুতির মূল বিষয় । এই প্রস্তুতির অভাবে অনেকের লক্ষ লক্ষ টাকা ঠিকই খরচ হয়, কিন্তু হজ্জ-ওমরার আসল মাকসাদ হাসিল হয় না । সুতরাং আগে আত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার । এরপরে অন্যান্য প্রস্তুতি ।
আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি কীভাবে গ্রহণ করা উচিত?
আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার সহজ উপায় হচ্ছে, যাদের আত্মা ইতোমধ্যে পরিশুদ্ধ আছে— তাদের থেকে আত্মা পরিশুদ্ধ করার উপায়-উপকরণ ও চিকিৎসা গ্রহণ করা । সেটা দু’ভাবে হতে পারে । ১। সোহবত বা সরসারি তাদের সান্নিধ্যে থেকে । ২। সোহবত গ্রহণ সম্ভব না হলে দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে তাদের লেখনীর মাধ্যমে উপকৃত হওয়া । দ্বিতীয় অপশনটিই আমাদের অনেকের জন্য সহজ । যে কারণে হজ্জ কিংবা ওমরায় যাওয়ার পূর্বে আমার পরামর্শ হচ্ছে সুযোগ থাকলে কিছুদিন আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবত গ্রহণ করা । একান্ত সে সুযোগ না থাকলে এ সংক্রান্ত কিছু কিতাবাদি পড়ে নেয়া । বাজারে এ সংক্রান্ত অনেক কিতাবাদি পাবেন, তবে আপনার পরিচিত কোন অভিজ্ঞ আলেমের সাহায্য নিয়ে কিতাব নির্বাচন করলে বেশি উপকৃত হবেন । এমনকি অনেক সময় ভুল তথ্য জানা থেকেও বেঁচে যাবেন ।
কী পড়বেন?
[আমার সংগ্রহে থাকা বেশ উপকারি কয়েকটি বইয়ের লিস্ট— যা থেকে আমি নিজে উপকৃত হয়েছি ।]
১। মূল আরবী—ওয়াফাউল ওয়াফা বি আখবারি দারিল মুস্তাফা (স.)
লেখক— আলী ইবনে আব্দিল্লাহ্ আস সামহুদী (৮৪৪—৯২২ হি.)
[মূল কিতাবটি চার খন্ডের । তবে এর খুলাসা বা সংক্ষিপ্ত সংস্করণও রয়েছে । একটি দু’ খন্ডের । আরেকটি এক খন্ডের । মদীনার অলিগলি, কুপ, মসজিদ এক কথায় মাহবুবে কিবরিয়া (স.) এর স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছু তুলে ধরা হয়েছে এ কিতবাটিতে । আমার অনুভূতি হচ্ছে— একজন আলেমের এই কিতাবটি মুতালাআ ছাড়া হারামাইন শরীফাইন জিয়ারাতে যাওয়া আর চোখের পাওয়ার কম এমন ব্যক্তি চশমা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া সমান কথা । তবে তাহকীককৃত সংস্করণ পড়া উচিত । কিছু মাসয়ালাগত বিষয় রয়েছে। ]
২। মূল আরবী— জাযবুল ক্বুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব
উর্দু অনুবাদ— তারিখে মদীনা
লেখক— শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিছে দেহলবী রহ. (৯৫৮—১০৫২ হি.)
৩। মূল আরবী— ফুয়ুযুল হারামাইন
উর্দু অনুবাদ— সাআদাতে কাওনাইন
লেখক— শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহ. (১১১৪–১১৭৬ হি)
৪। মূল (উর্দু) — সফরে হিজায
বাংলা অনুবাদ— সফরে হিজায
লেখক— মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী রহ. (১৩১০—১৩৯৭ হি.)
৫। মূল (উর্দু) — আপনে ঘর সে বায়তুল্লাহ্ তক
বাংলা অনুবাদ— বায়তুল্লাহর পথে
লেখক— সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. (১৩৩২—১৪২০ হি.)
৬। বাইতুল্লাহর মুসাফির
লেখক—আবু তাহের মিছবাহ দা.বা
৭। বাইতুল্লাহর ছায়ায়
লেখক— আবু তাহের মিছবাহ দা.বা
এর বাহিরেও আরো অনেক সফরনামা ও হজ্জ-ওমরা বিষয়ক কিতাব রয়েছে । সেগুলো থেকেও উপকৃত হতে পারেন ।
১। ফাজায়েলে হজ্জ
২। মুআল্লিমুল হুজ্জাজ
৩। রফিকে হজ্জ
৪। সিরাতুল হামীদ— এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ।
কেন পড়বেন?
এ সমস্ত ও সফরনামাগুলো কেন পড়বেন—এর উত্তর লিখে আমার কিংবা আপনার কারোই সময় নষ্ট করবো না । বরং কিতাবগুলো পড়ার পরে আপনার নিজের কাছেই এ প্রশ্নের ডজন ডজন উত্তর জমা হয়ে যাবে । তাই সময় নষ্ট না করে পড়া শুরু করে দিন । তবুও সংক্ষেপে বললে বলতে হয়— ১) ওনাদের মতো দিলের হালত ও নিয়তের ইখলাস তৈরি করতে । ২) পবিত্র ভূমি মক্কা-মদীনার একাল-সেকালের চিত্র জানতে । যেমন—
শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিছে দেহলবী রহ. এর কিতাব জাযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব ৯৯৮ হিজরীতে লেখা শুরু করে ১০০১ হিজরীতে শেষ করেছেন । শাহ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহ. এর ফুয়ুযুল হারামাইন কিতাবটিতে তিনি ১১৪৩ হিজরীতে করা তার হজ্জের সফরনামা তুলে ধরেছেন । সফরে হিজায কিতাবটিতে মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী রহ. ১৩৪৮ হিজরী সময়কার তার প্রথম হজ্জের সফর ও হারামাইনের চিত্র তুলে ধরেছেন । সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. ১৩০০ হিজরীর শেষের দিককার সফর ও সে সময়কার চিত্র একেছেন । আর আল ওয়াফা-উল ওয়াফা সম্পর্কেে তো পূর্বেই লিখেছি ।
[অবশ্য ওনাদের সফরনামায় উল্লেখিত সেকালে বিদ্যমান ইসলামের অনেক অনেক স্মৃতিময় ও বরকত স্থানসমূহ একালে বিলীন করে দেয়া হয়েছে ।]
জেনারেল ব্যাকগ্রাউন্ডের ভাই-বোনদের জন্য হজ্জ-ওমরার ধারাবাহিক নিয়ম-কানুন ও মাসআলা-মাসায়েল জানার ক্ষেত্রে প্রথম পরামর্শ হচ্ছে পরিচিত হক্কানি আলেমের শরণাপন্ন হওয়া । পাশাপাশি—
১। মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার প্রাক্তন উস্তাদ হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া (দা.বা) লিখিত— “হজ্জ ও উমরাহ পদ্ধতি ও মাসায়েল ।
২। মাওলানা তাহমিদুল মাওলা সাহেব সম্পাদিত “স্টেপ বাই স্টেপ উমরা গাইডলাইন”
৩। এবং শায়খ আহমাদুল্লাহ সাহেব লিখিত “উমরাহ কীভাবে করবেন”
এই কিতাব তিনটি থেকেও ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন । অনেক লম্বা তালিকা দিয়ে ফেললাম মনে হয় । এগুলো পড়লেই বাকি কিছু তালিকা নিজেই পেয়ে যাবেন— ইনশাআল্লাহ্ । আপনাদের হজ্জ-ওমরার সফরে আমি গুনাহগারের জন্য দোয়ার আর্জি রইলো । মা-আস্সালাম ।
পরবর্তী কোনোদিন লিখবো— যিয়ারাতে বাইতুল্লাহ্ ও যিয়ারাতে রওযায়ে হাবীবুল্লাহ (স.) এর তাওফীক লাভের জন্য কী কী আমল করবেন । ওয়া মা তাওফী-কী ইল্লা বিল্লাহ্ ।