একজন মানুষ অপর মানুষ ও জ্বীনদের বদনজর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে তা কমবেশি আমরা সকলেই জানি । আবার অন্যান্য প্রাণীও মানুষের ও জ্বীনদের বদনজর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে এটাও অনেকে জেনে থাকবেন । তবে মানুষ যে সাপ, কুকুর ও বিড়াল ইত্যাদির নজর দ্বারাও আক্রান্ত হতে পারে এ বিষয়টি আমরা অনেকেই জানি না ।
বিষয়টি অবশ্য মতভেদপূর্ণ । বেশিরভাগ ওলামায়ে কেরাম সমর্থন করলেও এর বিপক্ষেও কিছু ওলামায়ে কেরাম মতামত ব্যক্ত করেছেন । যারা সমর্থন করেছেন তাদের মধ্যে আবার কেউ সকল জন্তুদের বেলায় বদনজর সাব্যস্ত করলেও বেশিরভাগ আবার সুনির্দিষ্টভাবে সাপ ও কুকুরের বদনজরের ক্ষমতাকে সমর্থন করেছেন এবং অন্যান্য প্রাণীদের বদনজর দেয়ার ক্ষমতা নাকচ করেছেন । তবে অনেক আরব রাক্বীগনের মতে সাপ ও কুকুরের ন্যায় বিড়ালেরও নজরের প্রভাব রয়েছে ।
আমার কাছে প্রধান্যযোগ্য মত হচ্ছে— সুনির্দিষ্টভাবে সাপ ও কুকুরের নজরের ক্ষমতার কথা সরাসরি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । সাপের নজরের প্রভাবে চোখের জ্যোতি নষ্ট হওয়া ও গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত সংক্রান্ত একাধিক হাদীস; সিহাহ সিত্তার সকল কিতাবের মধ্যেই এসেছে । কুকুরের নজর বিষয়কও হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে মাওকুফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে । তবে বিড়ালের বদনজর বিষয়ক কোন হাদীস উল্লেখ না থাকলেও শায়খ খালিদ আল হিবশী সহ বড় মাপের আরব রাক্বীগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে ‘বিড়ালের নজর দ্বারাও মানুষ আক্রান্ত হতে পারে’ বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন । বিশেষতঃ অভুক্ত কুকুর ও বিড়ালের সামনে তাদেরকে না দিয়ে খাবার খেলে তাদের নজর লাগার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকেই মতামত ব্যক্ত করেছেন ।
সাপের নজর সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস :
১) সায়েবা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সমস্ত সাপকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন, যাহা ঘরে বাস করে। তবে যুততুফয়াতাইন ও আবতর জাতীয় সাপ হত্যা করতে নিষেধ করেননি। কেননা এই দুই প্রকার সাপ (তাদের নজরের মাধ্যমে) চক্ষু নষ্ট করে এবং মহিলাদের গর্ভ নষ্ট করে। মুয়াত্তা মালিক – হাদীস নং – ২৭৯৭ ।
“যুততুফয়াতাইন” ঐ সাপকে বলা হয়, যাহার পেটে দুইটি লম্বা সাদা দাগ আছে। যাহা মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত লম্বা। “আবতর” লেজকাটা বা ছোট লেজ বিশিষ্ট সাপকে বলা হয় এবং ঐ সমস্ত সাপকেও আবতর বলা হয়, যাহা আকারে খাটো। এগুলো অত্যন্ত বিষাক্ত হয়। এই সমস্ত সাপের শ্বাস-প্রশ্বাসেও বিষ আছে, এর কারণে মানুষের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং গর্ভবতীর গর্ভও নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য এই সমস্ত সাপকে হত্যা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
২) ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিম্বারের উপর ভাষণ দান কালে বলতে শুনেছন, ‘সাপ মেরে ফেল’। বিশেষ করে মেরে ফেল ঐ সাপ, যার মাথার উপর দু’টো রেখা আছে এবং লেজ কাটা সাপ। কেননা, এ দু’প্রকারে সাপ চোখের জ্যোতি নষ্ট করে দেয় ও গর্ভপাত ঘটায়। সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৩২৯৭, ৩২৯৮, ৩২৯৯ ও ৩৩০৮ ।
৩) ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আমি কুকুর নিধনের হুকুম জারী করতে শুনেছি, তিনি বলতেন, সাপগুলি আর কুকুরগুলি মেরে ফেল। আর (বিশেষত) পিঠে দু’সাদা রেখাবিশিষ্ট ও লেজবিহীন সাপ মেরে ফেল। কেননা এ দুটি মানুষের দূষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নেয় এবং গর্ভবতীদের গর্ভপাত ঘটায়। সহীহ মুসলিম- ২২৩৩ (৫৬৩২) ।
৪) সালিম ইবনু আবদুল্লাহ তার পিতা আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সাপ হত্যা করবে। তোমরা দু’ দাগ ও ক্ষুদ্র লেজ বিশিষ্ট সাপ হত্যা করবে। কেননা, এগুলো চোখের জ্যোতি নষ্ট করে এবং গর্ভপাত ঘটায়। সুনানে তিরমিযী- ১৪৮৩ (১৪৮৯)।
৫) আবূ লুবাবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সব সাপ মারতে নিষেধ করেছেন, যারা ঘরে বসবাস করে। তবে তিনি সে সাপ মারার নির্দেশ দেন, যাদের দু’টি মুখ এবং লেজ কাটা। কেননা, এরা বিষধর হওয়ার কারণে দৃষ্টি শক্তি নষ্ট করে এবং গর্ভস্থিত সন্তানের ক্ষতি সাধন করে।সুনানে আবু দাউদ- ৫২৫৩, ৫২৫৪, ৫২৫৫ (৫১৬৩) ।
৬) সালিম (রাঃ) থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমরা সাপ মেরে ফেলো, বিশেষত দু’মুখো সাপ এবং লেজবিহীন সাপ! কেননা এ দু’টি সাপ দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে এবং গর্ভপাত ঘটায়। সুনানে ইবনে মাজাহ – ৩৫৩৫ ।
৭) মুসনাদে আহমদ – ৪৫৫৭, ৪৭৩৭, ৪৮৫১, ৫১০৭, ৫১৩২, ১৫৭৪৮, ১৫৭৪৯, ১৫৭৫১ ।
কুকুরের নজর সংক্রান্ত (মাউকুফ) হাদীস :
১) হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, কুকুর দূর্বল জ্বীনদের শ্রেণিভুক্ত, (খাবার গ্রহণের সময়) যদি তা তোমাদেরকে ঘিরে নেয়, তার জন্য সামান্য খাবার নিক্ষেপ কর । কারণ তারও ‘নজর’ রয়েছে । আত-তামহীদ- খন্ড ১৪, পৃষ্ঠা ২২৯ । তা’বীলু মুখতালিফুল হাদীস – ২০৮ ।
বিড়ালের নজর সংক্রান্ত বিখ্যাত রাক্বী খালিদ আল হিবশীর অভিমত :
১) আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় কিছু মানুষকে বিশেষতঃ বিড়ালের ‘নজর’ দ্বারা আক্রান্ত পেয়েছি । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার সামনে খাবার গ্রহণের সময় এমনটা হয়ে থাকে। যখন নাকি সে ক্ষুধার্ত থাকে এবং উক্ত ব্যক্তির প্রত্যেক লোকমা গ্রহণের সময় তাকিয়ে থাকে । অতএব, তার (অভুক্ত বিড়ালের) সামনে খাবার গ্রহণের সময় ক্ষুদা নিবারণের জন্য তাকেও কিছু খাবার দেয়া উত্তম ।
উপর্যুক্ত মারফূ ও মাওকুফ হাদীস এবং ওলামাদের মতামত পর্যালোচনা সাপেক্ষে প্রাণীদের নজর বিষয়ে আমরা নিম্নোক্ত প্রধান্যযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি—
মানুষের উপরে সব ধরণের প্রাণীর বদনজরের প্রভাব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয় । সকল জাতের সাপের মধ্য থেকে হাদীসের ভাষ্যমতে কেবল মাত্র “যুততুফয়াতাইন” এবং “আবতার” সাপের নজরের প্রভাব অসংখ্য সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত । “যুততুফয়াতাইন” এবং “আবতার” সাপের নজর গর্ভপাত ও দৃষ্টিশক্তি নষ্টের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । (খাবারের সময়) কুকুরের বদনজরের প্রভাব হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর (মাওকুফ) হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । বিড়ালের বদনজরের প্রভাব হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয় । তবে অনেক বিজ্ঞ রাক্বীগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে এমনটা দাবী করেছেন । (আল্লাহু আ’লাম)
Mufti Muhammad Al-Amin
তারিখ – ২৩ রমাদান, ১৪৪৩