চেহারা ও সৌন্দর্যের বদনজর
চেহারা ও সৌন্দর্য হচ্ছে একজন মানুষের বদনজর পতিত হওয়ার কেন্দ্রবিন্দু । তবে কোন ব্যক্তি চেহারা ও সৌন্দর্যের বদনজরে আক্রান্ত হলে এর প্রভাব শুধু তাঁর চেহারা ও সৌন্দর্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে । শুধু চেহারা ও সৌন্দর্যের বদনজরের বেলায়ই নয় বরং যেকোন বিষয়ের বদনজরের ক্ষেত্রেই একই কথা । তবে হ্যাঁ, যে বিষয়কে কেন্দ্র করে বদনজর পড়বে, সে দিকটা তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।
সাহাবীদের মধ্যে সৌন্দর্য কেন্দ্রিক বদনজরে আক্রান্ত হওয়ার একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা রয়েছে। হয়তবা অনেকেই জেনে থাকবেন। সাহাল ইবনে হুনাইফ (রা.) নামে একজন সাহাবী ছিলেন। একদিন যখন তিনি গোসল করছিলেন, তাঁর সৌন্দর্যের উপরে আরেক সাহাবী আমের ইবনে রবীআ (রা.) এর নজর লেগে যায়। নজরের এতটাই তীব্র প্রভাব পড়ে যে, সাথে সাথে তিনি পানিতেই বেহুশ হয়ে পড়ে যান। অবস্থার তীব্রতা দেখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কেন তোমরা তোমারই ভাইকে (বদনজরের মাধ্যমে) হত্যা করো?
যাহোক, এখানে মূল পয়েন্ট হলো—সাহাবী সাহাল ইবনে হুনাইফ (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর। গোসলের সময় জামা খোলার পরে তাঁর ফর্সা স্কিন টোন ও কালার দেখেই মূলত অপর সাহাবীর নজর লেগেছিল । তাঁর মানে নজরটা ছিলো সৌন্দর্য কেন্দ্রিক। অথচ এর প্রভাবে তিনি বেহুশ হয়ে গেলেন । আবার নবীজী হত্যার সতর্কতা পযর্ন্ত উল্লেখ করলেন । বুঝা গেল বদনজর নিদির্ষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে পড়লেও অন্য ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে । যেমনটা এই ঘটনায় পড়েছিল— অজ্ঞান হওয়া ও মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হওয়ার মাধ্যমে ।
চিকিৎসাঃ প্রতিরোধ
কোন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রতিকার খোঁজার চেয়ে আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা উচিত । চেহারা ও সৌন্দর্যের বদনজর প্রতিরোধের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহন করা যেতে পারে ।
১) সৌন্দর্যকে লুকিয়ে রাখা। মানুষকে আকর্ষণ করে এমন প্রদর্শন থেকে যথাসাধ্য বিরত থাকা
নবী হযরত ইউসুফ (আ.) নিজে যেমন অনেক বেশি সুশ্রী ছিলেন; তাঁর অন্যান্য ভাইদের সৌন্দর্যও ছিলো চোখে পড়ার মতো। যেকারণে তাঁরা যখন মিশরে ত্রাণ সামগ্রী আনার জন্য গিয়েছিলেন, পিতা ইয়াকুব (আ.) তাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন—
তোমরা সকলে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না; বরং ভিন্ন-ভিন্ন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে । সূরা ইউসুফ-৬৭।
এই আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইউসুফ (আ.) এর এগারো ভাই সুশ্রী ও স্বাস্থ্যবান হওয়ার কারণেই ‘বদনজর এড়ানোর জন্য’ তাদের পিতা সবাইকে একসাথে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন ।
এছাড়াও হাদীস শরীফে বর্ণিতে হয়েছে— তোমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য গোপনীয়তার সাহায্য নাও, কারণ প্রত্যেক নেয়ামতপ্রাপ্ত লোকই হিংসায় আক্রান্ত । মাজমাউজ জাওয়াইদ ।
২) আরেকটি উপায় হচ্ছে— আকষর্ণের কেন্দ্রবিন্দুতে অস্থায়ী খুঁত তৈরি করে দেয়া
সুশ্রী বাচ্চারা বদনজরে বেশি আক্রান্ত হয় । এরকম অসংখ্য কেইস স্টাডি আমাদের কাছে আছে যে, সম্পূর্ণ সুস্থ একটি বাচ্চার হাসি বা দুষ্টুমির ছবি বা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চার প্রচণ্ড জ্বর উঠে অসুস্থ হয়ে গিয়েছে ।
অথবা সুস্থ বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে, মার্কেটে বা পার্কে গিয়েছিল । বাসায় ফেরার পরেই বাচ্চার হাসিখুশি ভাব চলে গিয়েছে । নেতিয়ে পড়েছে । অসুস্থ হয়ে পড়েছে ।
এখন ব্যাপার হচ্ছে— সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দেয়া না হয় এড়ানো গেলো, কিন্তু বিভিন্ন প্রয়োজনে বাচ্চাকে নিয়ে বাহিরে তো যেতেই হয় । ছোট বাচ্চাদের সবসময় মাস্ক বা নিকাব পড়িয়ে সৌন্দর্য্য লুকিয়েও রাখা যায় না । তাহলে উপায় কি? উপায় হচ্ছে— সৌন্দর্যের মধ্যে খুঁত তৈরি করা।
চলুন, এ সম্পর্কিত একটি হাদীস জেনে নেই ।
হযরত ওসমান (রা.) একটি সুশ্রী বাচ্চাকে দেখলেন; গালে টোল পড়ার দরুন যাকে দেখতে অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগছিল । তিনি নির্দেশ দিলেন, “বাচ্চাটির থুতনীতে কালি লাগিয়ে দাও ।” যাতে ওর উপর বদনজর না লাগে । শরহুস সুন্নাহ ।
তবে হ্যাঁ, সৌন্দর্যের মধ্যে খুঁত তৈরি করা সব সময় যে কালি মেখে দেয়ার মাধ্যমেই হবে তা কিন্তু নয়। বরং প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশে বাঁধা হয় এমন যেকোন কিছুই হতে পারে। হাদিসের ঘটনায় হযরত উসমান (রা.) খুঁত তৈরির একটি উপায় অবলম্বন করেছেন। আপনাকেও সেটিই করতে হবে জরুরী নয় । আপনি আপনার মতো করে একটি উপায় অবলম্বন করতে পারেন। মূল উদ্দেশ্য তথা সৌন্দর্য প্রকাশে বাঁধা হয়; এমন যেকোন কিছুই হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপঃ শীতের দিন, বাচ্চার চেহারার ত্বকটা কেমন শুকিয়ে গেছে। একটু লোশন বা ময়েশ্চারাইজার দিলে চেহারার উজ্জলতা (glownes) ফিরে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওকে নিয়ে বাহিরে যাওয়াও প্রয়োজন। আপনি ইচ্ছে করেই লোশনটা বাহিরে যাওয়ার আগে না দিয়ে বাসায় ফিরে দিতে পারেন । এটিও সৌন্দর্য প্রকাশে বাঁধা ও ইচ্ছাকৃত একটি খুঁত রাখা হলো । এভাবে যেকোনো কিছুই হতে পারে।
অনেকে আবার উপরের হাদিসটির মর্ম বুঝতে ভুল করেন। আর সেই ভুল থেকেই আমাদের দেশে বাচ্চাদের কপালে গোল করে বা চাঁদের আকৃতিতে কাজল দেয়ার প্রচলন শুরু হয় ।
মনে করা হয়, হাদিসে যেহেতু বদনজর এড়ানোর জন্য ‘কালি’ লাগিয়ে দিতে বলা হয়েছে; তাহলে কপালে ‘কাজলের কালি’ দিলে বাচ্চা বদনজর থেকে রক্ষা পাবে । অথচ এই ধারণা যে, শুধু হাদিসের ভুল অনুধাবন এতটুকুই নয়; বরং কপালে দেয়া ‘কাজলের বিন্দু’ বাচ্চাকে বদনজর থেকে রক্ষা করবে এই মনোভাব নিয়ে এটি করে থাকলে তা সরাসরি শিরক ।
হাদীস ও দেশীয় প্রচলনের বৈপরিত্য
হাদিসের বাক্যে খেয়াল করলেই কপালে কাজল দেয়ার সাথে এর পার্থক্য বুঝতে পারবেন—
১। হযরত উসমান (রা.) কালি দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন বাচ্চাটির থুতনীতে । অথচ আমাদের দেশে কাজল দেয়া হয় বাচ্চাদের কপালে ।
২। হযরত উসমান (রা.) এর উদ্দেশ্য ছিলো বাচ্চার সৌন্দর্য কমানো; যাতে বদনজরের সম্ভাবনা কমে যায় । অথচ আমাদের মায়েরা যেভাবে সুন্দর করে কপালে কাজল দেয়; এতে সৌন্দর্য কমা তো দূরের কথা! আরো বৃদ্ধি পায় । সাথে বদনজরের সম্ভাবনাও ।
৩। হযরত উসমান (রা.) এর নির্দেশনাটি ছিলো মানুষের নজর ঘুরানোর একটি টেকনিক মাত্র । সুন্দর একটি বাচ্চার থুতনীতে কালি লাগানো থাকলে মানুষের নজর ওর সৌন্দর্যের উপরে না পড়ে কালির উপরে পড়বে; এটাই ছিল উদ্দেশ্য । অথচ আমাদের মায়েরা কাজল দিয়ে থাকে বদনজরের চিকিৎসা হিসেবে । তাদের ধারণা কাজল দেয়া থাকলে বদনজরের প্রভাব পড়বে না । অথচ এতে নজর ঘুরে যাওয়া তো দূরের কথা, আরো আকৃষ্টতা বৃদ্ধি পায়।
চিকিৎসাঃ প্রতিকার
যেকোন বদনজরের সবচেয়ে সহজ ও দ্রুত কার্যকরী চিকিৎসা হচ্ছে—
১) গোসল
নজরদাতার পরিচয় জানা গেলে তার ওযূর পানি দিয়ে গোসল করা হচ্ছে বদনজরের প্রভাব নষ্টের সবচেয়ে সহজ, দ্রুত ও কার্যকরী চিকিৎসা । যেমনটি সাহাবী সাহাল ইবনে হুনাইফ (রা.) এর ঘটনায় হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে । তাঁর বদনজরে আক্রান্ত হয়ে বেহুশ হওয়ার ঘটনা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলে তিনি উপস্থিত অন্যান্য সাহাবীকে জিজ্ঞেস করলেন— তোমরা কাকে সন্দেহ করছো? তাঁরা যখন হযরত আমের ইবনে রবীআ (রা.) এর কথা বললেন । নবীজি তাকে ধমকালেন এবং গোসলের নির্দেশ দিলেন । এবং সেই গোসলের পানি গায়ে ঢালার সাথে সাথেই সাহাল ইবনে হুনাইফ (রা.) হুশ ফিরে পেয়েছিলেন ।
২) বদনজরের রুকইয়াহ ও গোসল
নজরদাতার পরিচয় জানা না থাকলে, বা কোন কারণে তাঁর ওযূর পানি সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে পরবর্তী করণীয় হচ্ছে— সূরা ফালাক, সূরা নাস ও হাদীসে বর্ণিত বদনজর নষ্টের দোয়া পড়ে রুকইয়াহ করা । পাশাপাশি এগুলো দিয়ে পড়া পানি তৈরি করে তা পান করা ও গোসল করা।
হাদীসে বর্ণিত বদনজর নষ্টের কয়েকটি দোয়া—
بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ، أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ اللَّهُ يَشْفِيكَ، بِاسْمِ اللَّهِ أَرْقِيكَ.
بِاسْمِ اللَّهِ يُبْرِيكَ، وَمِنْ كُلِّ دَاءٍ يَشْفِيكَ، وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ، وَشَرِّ كُلِّ ذِي عَيْنٍ.
أَعُيذك بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّةِ، مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ ، وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لَامَّةٍ
৩) রুকইয়াহর অডিও শোনা
যারা কুরআন বা দোয়া পড়তে পারেন না, তাদের জন্য তৃতীয় নম্বর করণীয় হচ্ছে বদনজর নষ্টের রুকইয়াহ শোনা।
চেহারা ও সৌন্দর্যের বদনজর নষ্টের জন্য বিশেষ কিছু আমল
১) সকালে ঘুম থেকে উঠে ও ঘুমানোর পূর্বে, ঘরের বাহিরে যাওয়ার পূর্বে ও বাহিরে থেকে ফিরে—হোম মেইড গোলাপজল, বাজার থেকে ক্রয় করা অর্গানিক গোলাপজল, জমজমের পানি, বৃষ্টির পানি অথবা এর কোনোটি না পাওয়া গেলে সাধারণ পানিতে নিম্নোক্ত আয়াতগুলো পড়ে ফুঁ দিয়ে চেহারা ধৌত করুন ।
- দরুদ শরীফ— (১ বার)
- সূরা কিয়ামাহ ২২ নম্বর আয়াত— (৭বার)
- সূরা হিজর এর ১৪ নম্বর আয়াতাংশ— وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ (৭ বার)
- সূরা মুমিনুন এর ১৮ নম্বর আয়াতাংশ— إِنَّا عَلَىٰ ذَهَابٍ بِهِ لَقَادِرُونَ (৩ বার)
- সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস (প্রতিটি ৩ বার)
- দরুদ শরীফ— (১ বার)
২) অডিও : চেহারা ও সৌন্দর্যের বদনজর নষ্টের রুকইয়াহ
বিঃদ্রঃ যাদের বিবাহ বন্ধের যাদু আছে তাঁরা পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার পূর্বে উপরোল্লেখিত নিয়মে পড়া পানি দিয়ে চেহারা ধৌত করে ও একবার রুকইয়াহ অডিও শুনে পাত্রপক্ষের সামনে যাবেন ।