সে বছর আমি হাটাহাজারী মাদরাসায় ‘দাওরা’ পড়ি । ‘শাহী গেট’ বরাবর দোতলায় ‘দারুল আমান’ ভবনের ৪৬০ নম্বর রুমে থাকতাম । ২০১৩ সালের ৬ই মে । রাত তখন আড়াইটা কি তিনটা । গভীর ঘুমে বিভোর ছিলাম । হঠাৎ কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল । সজাগ হয়ে টের পেলাম শুধু একজনের নয় বরং গণ কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে ।
কাকুতি-মিনতি ভরা কণ্ঠে এধরণের কান্নার আওয়াজ শুনে আমি অভ্যস্ত । তবে তা তো আসার কথা জামিয়ার জাদীদ ও ক্বদীম মসজিদদ্বয় থেকে! মাগরিবের পূর্ব মুহূর্তে এবং তাহাজ্জুদের সময় জামিয়ার মসজিদদ্বয় থেকে তালিবুল ইলমদের এ ধরণের কান্নার আওয়াজ (মুনাজাতে) প্রতিদিনই শুনা যায় । তবে আজ কেন রুম থেকে এ আওয়াজ আসছে । তাহলে কি আসাতিজায়ে কেরামের মধ্য থেকে কেহ মারা গেলেন নাকি? বাবুনগরী (দা.বা) এবং মুহতামিম সাহেব (দা.বা) তো এমনিতেই অসুস্থ; তাদের আবার কিছু হলো না তো! এসব ভাবতেই অন্তরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল । সজাগ হয়ে ঘুম ঘুম চোখে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে এসব ভাবনা মাথায় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ।
আপডেট — যে ববছর এই পোস্টটি প্রথম লিখি; তখন উভয় হযরতদ্বয় জীবিত ছিলেন । রহিমাহুমাল্লাহ্ ।
হঠাৎ কান্নামাখা কণ্ঠে কারো ঘোষণা আসল “ভাইয়েরা ‘উঠি-উঠি’ । সবাই দোয়ায় মশগুল হয়ে যাই । শাপলা চত্ত্বরে আমাদের ভাইদেরকে গণহত্যা করা হচ্ছে । তাদের উপরে শত শত রাউণ্ড উপর্যুপরি গুলি ছোড়া হচ্ছে ।”
ইতোমধ্যে রুমের সবাই সজাগ হয়ে গিয়েছে । বাতি জ্বালানো হলো । সবাই যে যার মত করে উঠে অযু খানার দিকে দৌড়াতে লাগল । বেশিরভাগই কাদছে আর দৌড়াচ্ছে । ঠিক সেই মুহুর্তটায় টের পেয়েছিলাম সহপাঠীর জন্য কতটা মায়া থাকতে পারে! আমাদের এক ক্লাসেই তখন ছাত্র ছিল তিন হাজার প্রায় । নিজ ক্লাসমেটকে চেনাই সেখানে সম্ভব নয় । সর্বোচ্চ দুইশত জনের সাথে সাধারণ পরিচয় ছিল । আর জন পঞ্চাশেক ছাত্রের সাথে হয়ত মোটামুটি পরিচয় ছিল । আর বাকি সবাই-ই ছিল অচেনা । অথচ তাদের বিপদের এ সংবাদ শুনে; সবার গণ্ডদেশই ছিল চোখের পানিতে সিক্ত ।
আসলে এ বন্ধন ছিল দ্বীনি বন্ধণ । এ মহব্বত ছিল ইলমের মহব্বত । কেয়ামতের ময়দানে আরশের নিচে ছায়া পাওয়ার ওসীলাস্বরুপ; আল্লাহর জন্য মহব্বত । ছাত্রভাইদের সেদিনকার সেই বুকফাটা আর্তনাদ আজও যেন কানে শুনতে পাই । দৃশ্যগুলো যেন এখনো মানসপটে ভাসে ।
যারা সেদিন শাহাতের অমিয় সুধা পান করেছিলেন, আল্লাহ তাদের শাহাদাতকে ক্ববুল করুন । আমাদের সকলকেও আল্লাহ শহীদি মৃত্যু দান করেন । আমীন ।